‘আমাগো অভিভাবক মন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি নাকি আমার মেয়েসহ দুজন মরার কথা বলতে বলতে হাসতে ছিলেন। এই কথা শুইনা আমার দুঃখে বুক ভাইঙা আসছে। আমি আর বাস চালামু না। যেই বাস আমার মেয়েরে নিয়া গেল। সেই বাস আর ধরুম না আমি। আমি সারা জীবন বাস চালাইছি সেই ছোট থাইকা কেউ আমার গাড়িতে অ্যাকসিডেন্ট হয় নাই। আমি তো কাউরে মারি নাই। তাইলে আমার মতো মানুষের মেয়ের কপাল কেন এমন হইল?’ রবিবার দুপুরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় নিহত শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম এসব কথা বলছিলেন আর বিলাপ করছিলেন। জাহাঙ্গীর বলেন, আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই। এটা তো দুর্ঘটনা না। পুলিশ আমাকে বলছে মামলা করতে। মেয়েরে পোস্টমর্টেম ছাড়াই মাটি দিছি। শুনেছি এটা দুর্ঘটনা। এটা তো হত্যা। আমি কেন, সবাই বলবে এটা হত্যা।
রবিবার দুপুরে রাজধানীর মহাখালীর দক্ষিণপাড়ার জিপি-ক/৭৫ নম্বর জাহাঙ্গীরের বাসার নিচতলায় গিয়ে দেখা যায়, তিনি মেয়ের শোকে আহাজারি করছিলেন। জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা-রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে ২৭ বছর ধরে একতা পরিবহনের গাড়ি চালান। আহাজারি করতে করতে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, অনেক কষ্ট করে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করিয়েছি। বড় মেয়ে রোকেয়া টিএনটি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে রিয়াদ স্থানীয় আইপিএইচ স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। দিয়ার মা রোকসানা বেগম বলেন, আমি কিছুই চাই না। মেয়ে হত্যার বিচার চাই। প্রতিদিন মেয়েকে গাড়িতে উঠাই দিয়া আমি আইসা পড়ি। এই মহল্লার অনেকে ওই কলেজে পড়ে। ওগো লগে মেয়ে আমার আইসা পড়ে। মেয়ে আমার কাছে কিছুই চাইতো না। ওর কোনো চাহিদা নাই। যা দেই তাই খায়। শুধু চাইছে, মা আমি ওই কলেজে পড়মু আমার খুব ইচ্ছা। মেয়ের ইচ্ছা পূরণ করলাম। সেই লক্ষ্মী মেয়ে আমার এভাবে মারা গেল। মা আমার নাচ-গান এগুলো খুব পছন্দ করত। আমিও বাধা দিতাম না। বিলাপ করতে করতে তিনি বলেন, আমার বড় মেয়ে রিয়ার লগে ওর কি ভালো ভাব। দুজনে আমার সংসারের সুখ। এক ছেলে ছোট। কষ্টের সংসারে ওরাই আমার মন ভইরা রাখত। এখন আমার মা নাই। আমাদের ছেড়ে চলে গেল। ঠিক এক মাস আগে ও কলেজে ভর্তি হয়। এক মাস পরই চলে গেল আমাদের ছেড়ে। মা আমার এই অল্প সময়ে সবাইরে আপন করে লইছিল। সব কথা আমারে কইত। কলেজে কী কী হইতো সব কইত। ওর কয়েকটা বই কম ছিল। তাও কালকে কিনা রাখছি। দিয়ার বড় বোন রোকেয়া খানম রিয়া বলেন, প্রতিদিন ফজরের নামাজের আজান শুনে ঘুম ভাঙত দিয়ার। ওজু করে নামাজ পড়ত। এটা কখনো মিস হয়নি। এরপর দ্রুত কলেজ ব্যাগ, পোশাক ও অন্য কাজ করে নিজেকে প্রস্তুত করত। হালকা নাস্তা করে বাসা থেকে ঠিক সাড়ে ৬টায় বেরিয়ে যেত। কখনো মা আবার কখনো বাবা তাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসত। তার স্বপ্ন ছিল নিজেকে ব্যাংকার হিসেবে গড়ে তোলা। কিন্তু তার সে স্বপ্ন আর কখনই পূরণ হবে না। রিয়া আরও বলেন, প্রতিদিন বেলা ১টার দিকে কলেজ থেকে বাসায় ফিরত দিয়া। বাসায় এসে নিজের রুমে একটু বিশ্রাম নিত। লেখাপড়ায় বেশ মনোযোগ ছিল। কিন্তু রবিবার সকালে বাসা থেকে ঠিকই বের হয়, কিন্তু সে আর বাসায় ফিরল না। যাদের কারণে আমার বোনকে হারালাম তাদের বিচার চাই। আর কারও বোন যেন এভাবে হারিয়ে না যায়। গতকাল দুপুরে দিয়ার মতো কলেজ ড্রেস পরে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আমাদের বাসায় এসেছিল। ড্রেস দেখে বুঝলাম, তারা সবাই দিয়ার সঙ্গে পড়ে। দিয়ার রুমে গিয়ে তারা নির্বাক হয়ে যায়। সান্ত্বনার সব ভাষা হারিয়ে তারাও ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করে।
এ সময় দিয়ার সহপাঠীরা জানায়, দিয়া খুব সাহসী ছিল। তার ফ্যাশনের প্রতি ঝোঁক ছিল বেশি। সব সময় হাসি-খুশি থাকত। দুষ্টুমি-খুনসুটিতে ছিল প্রাণচঞ্চল। এজন্য অল্প সময়ে সে সবার মন কেড়ে নেয়। তাকে ভালোবেসে সবাই ক্লোজআপ কুইন বলে ডাকত।